ডা. এম ইয়াছিন আলী: অস্টিওপোরোসিস বা অস্থি ক্ষয় বা হাড়ের ক্ষয় রোগ এমন একটি অসুখ, যার কারণে হারের ঘনত্ব নির্দিষ্ট মাত্রায় কমে যাওয়ায় হাড় দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ২০ থেকে ৩৫ বছর হাড় তার পূর্ণতা লাভ করে, তারপর ৪০ বছরের পর থেকে হাড় তার ক্যালসিয়াম ও ফসফেট হারাতে থাকে। এতে হাড়ের পরিবর্তন হয়, দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। ৫০ বছর বয়সে ১৫ ভাগ এবং ৭০ থেকে ৮০ বছর বয়সে ৩০ ভাগ মহিলার হিপ বোন বা নিতম্বের হাড় ভেঙে যায়।
অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ের ক্ষয় রোগ কী?: হাড়ের ভেতরের ঘনত্ব বাড়া-কমা একটি চলমান প্রক্রিয়া। ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সের দিকে হাড়ের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি হওয়া বন্ধ হয়ে যায়; কিন্তু ২০ বছর বয়স পর্যন্ত হাড়ের ভেতরের ঘনত্ব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত হাড়ের গঠন ও ক্ষয় একসঙ্গে একই গতিতে চলতে থাকে। ৪০ বছর বয়সের পর থেকে প্রাকৃতিক নিয়মে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাড় ক্ষয়ের মাত্রা একটু একটু করে বাড়তে থাকে। তাই নির্দিষ্ট বয়সে হাড়ের ক্ষয় একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। হাড়ের এ ক্ষয় বাড়তে বাড়তে হাড় যখন নরম ও ভঙ্গুর হয়ে যায়, সেই অবস্থাকে অস্টিওপোরোসিস বলা হয়।
অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ের ক্ষয় রোগের প্রাদুর্ভাব?: এ রোগে মহিলা ও পুরুষ উভয়ই আক্রান্ত হয়, তবে মহিলাদের, বিশেষ করে মেনোপজ বা ঋতুস্রাব বন্ধের পর শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোন কমে যায়। এ কারণে হাড়ের ক্ষয়ের মাত্রা বেড়ে যায় এবং পুরুষের টেস্টোস্টেরেন হরমোন ৭০ বছর বয়সে কমতে শুরু করে, তখন হাড়ের ক্ষয় শুরু হয়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বে ৫০ বছরের অধিক বয়সের প্রতি তিনজন মহিলার মধ্যে একজন এবং প্রতি পাঁচজন পুরুষের একজন অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ের ক্ষয় রোগ হয়। যারা অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ের ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হন, তাদের মধ্যে ৮০ ভাগ মহিলা এবং ২০ ভাগ পুরুষ।
কাদের অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বেশি?: বর্তমানে অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ের ক্ষয় রোগ বিশ্বব্যাপী বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে হুমকির সম্মুখীন করে ফেলেছে। অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকিপূর্ণরা হলেন:Ñ
১. মেনোপজ বা ঋতুস্রাব বন্ধ-পরবর্তী মহিলারা।
২. এশীয় বা ককেশিয়ানরা।
৩. যাদের পরিবারের কারও অস্টিওপোরোসিস আছে।
৪. যারা পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি গ্রহণ করেন না।
৫. যারা ব্যায়াম করেন না।
৬. যাদের ওজন কম।
৭. ধূমপায়ীরা ও অ্যালকোহল পানকারীরা।
৮. কিছু অসুখ অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। যেমন
– রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিস।
– যাদের শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা কম।
– যাদের শরীরে টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা কম।
– যাদের শরীরে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেশি।
– যাদের শরীরে প্যারাথাইরয়েড হরমোনের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেশি।
– যেসব রোগে খাবারের শোষণ ব্যাহত হয়।
– যেসব রোগে অনেক দিন শুয়ে থাকতে হয়। যেমন:
Ñব্রেনস্ট্রোক।
– এইচআইভি।
– স্তন ক্যান্সার।
৯. কিছু ওষুধ ও অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। যেমন:
– তিন মাসের অধিক সময় ধরে কটিকস্টেরয়েড ট্যাবলেট খেলে।
– খিঁচুনি রোধী ওষুধ খেলে।
– স্তন ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ।
– প্রস্টেড ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ ইত্যাদি।
অস্টিওপোরোসিস নির্ণয়ের পরীক্ষা
অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ের ক্ষয় ও দুর্বল রোগ সহজেই নির্ণয় করা যায়Ñ
১. ক্লিনিক্যাল উপসর্গ এবং স্বাভাবিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে : ডাক্তার আপনার শারীরিক বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল উপসর্গ পর্যবেক্ষণ এবং পূর্ববর্তী রোগ ও ওষুধ
গ্রহণের ইতিহাস এবং বিভিন্ন ঝুঁকি পর্যবেক্ষণ করে আপনার অস্টিওপোরোসিস আছে কিনা নির্ণয় করতে পারেন।
২. হাড়ের এক্স-রে: ডাক্তার আপনার শরীরের হাড়ের এক্স-রে করে তাদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তারা আপনার হাড়ের ঘনত্ব বুঝতে পারেন।
৩. বিএমডি (বোন মিনারেল ডেনসিটি) বা হাড়ের ঘনত্ব নির্ণয় পরীক্ষা: আপনার অস্টিওপোরোসিস হয়েছে কিনা পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে জানতে বিএমডি (বোন মিনারেল ডেনসিটি) বা হাড়ের ঘনত্ব নির্ণয় পরীক্ষা করা হয়। এটি সাধারণ এক্স-রে স্ক্যানিংয়ের মতো একটি স্ক্যান বা পরীক্ষা, যা সম্পূর্ণ ব্যথামুক্ত, সহজ এবং যেটা খুব সামান্য রেডিয়েশন ব্যবহার করে করা যায়।
অস্টিওপোরোসিসের পরিণতি কী?
অস্টিওপোরোসিস একটি নীরব ক্ষয় রোগ। প্রাথমিক অবস্থায় অস্টিওপোরোসিসের তেমন কোনো উপসর্গ দেখা দেয় না। অস্টিওপোরোসিস তখনই যন্ত্রণাদায়ক হয়, যখন হাড়ে ফাটল ধরে বা হাড় ভেঙে যায়।
অস্টিওপোরোসিসে হাড়ের ঘনত্ব কমে হাড় দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। এতে দেখা যায় যে, খুবই সামান্য পরিমাণ আঘাত পেলে বা দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে গিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গার হাড় ভেঙে যেতে পারে।
সাধারণত প্রথমবার হাড় ভাঙার আগে কোনো উপসর্গই দেখা যায় না। অস্টিওপোরোসিসের কারণে শরীরের যে কোনো জায়গার হাড় ভেঙে যেতে পারে তার মধ্যে মেরুদ-ের হাড়, নিতম্ব বা হিপ জইন্ট, কব্জি বা রিস্ট জয়েন্টের হাড় ভাঙার পরিমাণ বেশি লক্ষ করা যায়।
কীভাবে অস্টিওপোরোসিস বা হাড় ভাঙা প্রতিরোধ করবেন
শৈশব, কৈশোর অথবা যৌবনকালে অর্থাৎ বাড়ন্ত বয়সে হাড়ের বৃদ্ধি সাধন হয়। সেই সময়টাই হাড়কে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার আসল সময়। এ সময় হাড়ের ঘনত্ব পর্যাপ্ত পরিমাণে গঠন করে নিতে পারলে তা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাড়ের ক্ষয় এবং ভাঙার ঝুঁকির বিরুদ্ধে টিকে থাকতে সক্ষম হয়।